সুনামগঞ্জ , শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫ , ১৩ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
মাছ বাজারে প্রতারণার ফাঁদে ক্রেতারা বালুপাথর মহালের ইজারা বন্ধ নয়, ইজারা প্রথার বাতিল চাই ১১ মাসে অর্ধ শত কোটি টাকার বালু লুট জগন্নাথপুরে ৩ আসামি গ্রেফতার টাঙ্গুয়ার হাওরে গাঁজা সেবন ও উচ্ছৃঙ্খল আচরণ, ৫ পর্যটককে কারাদন্ড মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস পালিত “মধ্যনগরে রাজহংস হাউজ বোট বিএনপি নেতার দখলে” শীর্ষক সংবাদের প্রতিবাদ কাদাজলে নষ্ট ভাটির বন্দরের সুনাম সাবেক সিইসি হাবিবুল আউয়াল গ্রেপ্তার চোরাকারবারিদের কোনো ছাড় নয় : বিজিবি অধিনায়ক টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্র : অবহেলায় ধ্বংসের পথে রাষ্ট্রীয় সম্পদ আদারবাজারে সুপেয় পানি ও শৌচাগার সংকট ‘৩১ দফা’ বাস্তবায়নে বিএনপি নেতা অ্যাড. নূরুল ইসলামের গণসংযোগ শান্তিগঞ্জে ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ৫ পাঠদান ব্যাহত, নিজ ক্যাম্পাসে ইন্টার্নশিপ করতে চান শিক্ষার্থীরা আবারও ছাতক সীমান্তে ২০ জনকে পুশইন পৌর শহরে ক্লিনিং ক্যাম্পেইন, মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংসের আহ্বান গাঁজার চালানসহ মাদক কারবারি হেলাল আটক যুবকের মৃতদেহ উদ্ধার, বন্দুক, পাইপগান, গুলিসহ গ্রেফতার ৪ শান্তিগঞ্জে সিএনজি ও প্রাইভেট কার সংঘর্ষে আহত ৫

বালুপাথর মহালের ইজারা বন্ধ নয়, ইজারা প্রথার বাতিল চাই

  • আপলোড সময় : ২৭-০৬-২০২৫ ০২:৩৮:০৮ পূর্বাহ্ন
  • আপডেট সময় : ২৭-০৬-২০২৫ ০২:৪৩:৫৭ পূর্বাহ্ন
বালুপাথর মহালের ইজারা বন্ধ নয়, ইজারা প্রথার বাতিল চাই
ইকবাল কাগজী ::
বালু-পাথর নিয়ে দেশে তোলপাড়-তেলেসমাতি চলছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বালু-পাথর উত্তোলন আপাতত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মহাল খোলে দেওয়ার জন্যে দেশের রাজনীতিক দলগুলো একাট্টা হয়ে পড়েছে।
২৪ জুন ২০২৫ তারিখের দৈনিক খবরের কাগজ-এ খবরের শিরোনাম করা হয়েছে, ‘পাথরমহাল খুলে দেওয়ার দাবিতে একাট্টা বিএনপি-জামায়াত-এনসিপি’। মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সমন্বয়ক শাব্বীর আহমদ ফয়েজ-এর বরাত দিয়ে লেখা হয়েছে ‘পরিবেশ রক্ষার দোহাই দিয়ে বন্ধ রাখা সিলেটের পাঁচটি পাথরমহাল খুলে দেওয়ার দাবিতে “সিলেট জেলা পাথরসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ” নামের সংগঠনটি ১৮ জুন সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়- “পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানসহ জ্বালানি উপদেষ্টা গত ১৪ জুন জাফলং ঘুরে যান। সেখানে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে সিলেটের পাথরমহাল (কোয়ারি) আর লিজ দেওয়া হবে না বলে ঘোষণা দেন। এতে আমরা ব্যথিত ও হতাশ হয়েছি।’ ব্যথিত ও হতাশ হওয়ার কথাই বটে। বালুপাথর শ্রমিকসহ দেশের অন্যান্য সচেতনমহলও এই একইভাবে ব্যথিত ও হতাশ হয়েছেন কেবল পাথরমহাল বন্ধ করে দেওয়ার জন্যে নয়, সেই সঙ্গে অদূর ভবিষ্যতে মহাল খোলে দেওয়ার পর লাভের লোভে পরিচালিত হয়ে প্রকৃতিবিরোধী অরাজক পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতা থেকে ক্ষতি আরও আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কায়। আশঙ্কা কেবল প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতা বৃদ্ধি পাওয়ার দিক থেকে নয়, বালুপাথর শ্রমিকদেরকে শোষণ করার রামরাজত্ব কায়েম করে হাতে গোনা কয়েকজন ধনী লোকের আরও ধনী হয়ে উঠার পথ প্রসারিত হওয়ারও। দেশে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বদৌলতে ক্ষমতাসীন অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে এবংবিধ বৈষম্য বাড়ানোর আর্থনীতিক ক্ষেত্র খোলে দেওয়া কোনও বিচারেই যুক্তিযুক্ত নয়, বরং ঘোরতর অন্যায় বলেই প্রতিপন্ন হয়। আসলে বালুপাথর মহালের ইজারা বন্ধ নয়, ইজারা প্রথার বাতিলের পক্ষে সাধারণজন ও মেহনতি-গরিব মানুষের অবস্থান। যাঁরা বালুপাথর তোলার কাজ করে নিজের ও নিজের পরিজনের জীবন চালান, তাঁরা নতুন করে খবরের কাগজে উক্ত ‘পাথরসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী মালিক’দের লাগামহীন লাভের কারবারের শিকার হতে চান না। এই ব্যবসায়ীরা লাভ করতে চান। ব্যবসায়ীর লাভ তৈরি হওয়ার প্রাথমিক শর্ত শ্রমিক শোষণ। শ্রমিকশোষণ সম্ভব না হলে ব্যবসায়ীর লাভ তৈরি হয় না, তাঁরা ধনী হতে পারেন না। অথচ এই তাঁরা ‘পাথরসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ’ গড়ে নিয়েছেন, আর তাতে আসন্ন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন হওয়ার আকাক্সক্ষায় উজ্জীবিত রাজনীতিকদলগুলোর সমর্থন-আশির্বাদে পুষ্টি লাভ করে ধনী আরও ধনী হয়ে ধনবৈষম্য বৃদ্ধির ও পরিবেশের ভারসাসম্যহীতা অব্যাহত রাখার পথ খোলে দেওয়া পাঁয়তারা শুরু হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে কয়েকজন ধনী লোকের ধন লাভের খায়েশ চরিতার্থ করার জন্যে লক্ষ লক্ষ মেহনতি গরিব মানুষকে বঞ্চনার ফাঁদে ফেলে গরিবি ও প্রতিক‚ল প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে (প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতার মধ্যে) ঠেলে দেওয়র অধিকার কারও নেই। আমাদের অন্তর্বর্তী সরকারকে “সিলেট জেলা পাথরসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ” গঠনের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা আসল রহস্য, অর্থাৎ লাগামছাড়া মুনাফা অর্জনের কেরামতি ফলানোর ব্যাপারটিকে বুঝতে হবে এবং সেটাকে, অর্থাৎ মুনাফা অর্জনের কেরামতিকে, প্রতিরোধ করে বালুপাথর উত্তোলন বা আহরণের কাজ চালিয়ে যেতে হবে। তাই বলে বালুপাথরমহাল থেকে বালুপাথর উত্তোলন বন্ধ করে দেওয়াও ঠিক কাজ নয়, বরং বালুপাথর উত্তোলনের বা আহরণের কাজ চালিয়ে যেতে পারাই সর্বাধিক উত্তম পথ। অনেকটাই ‘সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না’ এমন একটি ব্যবস্থা নিতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না যে, প্রাণপ্রকৃতিবিনাশী এই কর্মকাÐের ফলে নদীতীরবর্তী এলাকাজুড়ে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হাজারো একর ফসলি জমি এবং ক্রমাগত হচ্ছে। এই সকল অপকর্মের মূলে রয়েছে মোগল আমলে প্রবর্তিত ইজারাদারি প্রথা, যার ভেতরে লুকিয়ে আছে শ্রমিকশোষণসহ জাল-জালিয়াতি, প্রতারণা, শঠতা, ভন্ডামী, গুন্ডামির আদলে জনসমাজের সম্পদ আত্মসাতের জন্যে সমাজ পরিসরে আধিপত্যের বিস্তার, সমাজের সর্বস্তরে মাফিয়াচক্রের দখলদারি। সুনামগঞ্জ জেলা বারকিশ্রমিক সংঘ (রেজি. নং- চট্ট-২৩৫৫)-এর প্রতিনিধিরা তাঁদের দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতালব্ধ বাস্তবতা থেকে এমন অভিমতই প্রকাশ করেন। সরকার বালুপাথর মহাল লিজ বা ইজারা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। এক অর্থে এই সিদ্ধান্ত ঠিক আছে। ইজারা পদ্ধতিতে যথাযথ তদারকি ব্যতিরেকে ঠিকাদার ও প্রশাসনিক দুর্নীতিবাজদের যোগসাজশে ইজারানিয়ম লঙ্ঘন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠে এবং ফলে শ্রমিকমেহনতি মানুষকে চরমমাত্রায় শোষণ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতা অধিক হারে বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে। এই দুরবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে বালুপাথর উত্তোলেন বা আহরণের বিকল্প পথ সন্ধান তাই অনিবার্য হয়ে উঠেছে, যেহেতু বালুপাথর উত্তোলন বা আহরণের কাজ বন্ধ রাখা কোনও যুক্তিতেই সমীচীন নয়। কারণ বালুপাথর উত্তোলন বা আহরণের কাজের সঙ্গে ভাটি অঞ্চলের লক্ষ লক্ষ মেহনতি গরিব মানুষসহ অন্যান্য শ্রেণি-পেশার লোকজন কোনও-না-কোনওভাবে জড়িত। যেমন এই কাজের সঙ্গে জড়িত আছেন নৌযান শ্রমিক, লোড-আনলোড শ্রমিক, ট্রাক শ্রমিক, চা-দোকনী, মোদি-দোকানী, হোটেল-রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী ইত্যাদি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষজন। অর্থাৎ এই বালুপাথর মহালকে কেন্দ্র করে শত বছর কাল পরিক্রমার পরিসরে একটি বিশাল আর্থনীতিক কর্মযজ্ঞ গড়ে উঠেছে। অনুমান করা হয়, এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা সচল ও সম্পর্কিত। বলাই বাহুল্য, বালুপাথর মহাল ভাটি অঞ্চলে একটি আর্থনীতিক অঞ্চল। এদিক থেকে বিবেচনায়, বালুপাথর উত্তোলন বা অহরণ বন্ধ করে দেওয়া একটি আত্মঘাতী কাজ। তাই বলি, আমাদেরকে বালুপাথর তোলতে হবে এবং তা থেকে কায়েমী সার্থবাদী শোষকদের স্বার্থ উদ্ধারের পথ বন্ধ করে দিয়ে শ্রমিক-মেহনতি গরিব মানুষের আয় উপার্জনরে পথ খোলে দিতে হবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সংক্ষিপ্তাকারে কীছু প্রস্তাব উপস্থাপন করা হলো : এক. সরকারিভাবে পাথর বালি ক্রয়কেন্দ্র অবিলম্বে চালু করে হাজার হাজার শ্রমজীবী মানুষের কাজের সুযোগ তৈরি করতে হবে। দুই. পরিবেশবিধ্বংসী বোমা মেশিন, শ্যালো মেশিন, ড্রেজার ও সেইভের সাহায্যে নদী থেকে বালু-পাথর উত্তোলন বন্ধ করতে হবে। তিন. পাথর বালু মহালে ইঞ্জিনচালিত স্টিলবডি নৌকা সরাসরি প্রবেশ বন্ধ করতে হবে। চার. সিন্ডিকেটের মাধ্যমে শ্রমিকদের জিম্মি করা বন্ধ করতে হবে। পাঁচ. পরিবেশবান্ধব উপায়ে হাতে ব্যবহারযোগ্য বেলচা, বালতি ও নেটের সাহায্যে বালু-পাথর, কয়লা আহরণ উন্মুক্ত করতে হবে। ছয়. উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অমান্যকারীসহ বোমা মেশিন, শ্যালো মেশিন, ড্রেজার, সেইভের মাধ্যমে নদী, পাহাড়, জনপদ ধ্বংসকারীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সাত. সর্বজনীন রেশনিং ব্যবস্থা অবিলম্বে চালু করতে হবে। এখানে ‘সরকারিভাবে পাথর বালি ক্রয়কেন্দ্র চালু’র বিষয়টিকে স্পষ্ট করা দরকার। প্রথমেই মাফিয়াচক্রের আধিপত্য বিস্তার রোধে বালুপাথর মহালগুলোকে একধরণের সংরক্ষিত এলাকার মতো করে তোলতে হবে এবং সনাতন পদ্ধতিতে বালুপাথর আহরণের (ড্রেজার-বোমাসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি দিয়ে বালুপাথর উত্তোলন নয়) কাজ করার ব্যবস্থা চালু করতে হবে। সরকারিভাবে ক্রয়কেন্দ্র চালু করে খাদ্য অধিদপ্তর কতৃক পরিচালিত ‘টিসিবি’র আদলে বালুপাথরের মূল্যনির্ধারণ পূর্বক ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। টিসিবি’র পণ্য ক্রয়বিক্রয়ে সরকার নির্ধারিত ব্যবসায়ীরা নিয়োজিত থাকেন। তাঁরা নির্দিষ্ট নিয়মে সরকারি কোষাগারে সরকারের প্রাপ্য ভ্যাট, ট্যাক্স ও পণ্যের মূল্য পরিশোধ করেন। বালুপাথর মহালে অনুরূপভাবে নির্দিষ্ট ব্যবসায়ীরা সরকারি কোষাগারে সরকার নির্ধারিত ভ্যাট, ট্যাক্স ও রয়েলিটি পরিশোধ করবেন এবং তাঁরা এইভাবে সরকারি অনুমোদন সাপেক্ষে নির্দিষ্ট পরিমাণ বালুপাথর সরকার নির্ধারিত স্থান থেকে ক্রয় এবং বিক্রয় করবেন। ইজারা প্রথা বাতিল করে প্রস্তাবিত এই পদ্ধতিতে সরকার রাজস্ব আদায় করার ব্যবস্থা নিলে বর্তমান ইজারা পদ্ধতির চেয়ে শতগুণ বেশি রাজস্ব আদায় সম্ভব হতে পারে। তাছাড়া এর চেয়ে আরও অধিক কোনও বিকল্প ব্যবস্থাপনা যদি সরকার অবলম্বন করতে পারেন তাহলে আরও ভালো হয়। এর ফলে বালুপাথর মহালকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা ব্যাপক আর্থনীতিক কর্মকান্ড সচল থাকবে, লক্ষ লক্ষ বালুপাথর শ্রমিকের জীবন-জীবিকা সচল ও সহজ হবে, মাফিয়াচক্রের আধিপত্য হ্রাস হবে, সরকারি রাজস্ব বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে।
[লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, তারিখ : ২৬.০৬.২০২৫]

নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha

কমেন্ট বক্স